জল বেড়েছে কোমর অবধি। মজনু নাওখানা শক্ত করে ভেজা রেইন্ট্রির সঙ্গে বাঁধে। রেইন্ট্রিগাছের শরীরটা নরম। শক্ত করে দড়ি বাঁধতেই খানিক চল্টা উঠে আসে। মজনুর পায়ের মতো। জলে ভেজা আঙুল আর গোড়ালি থেকে চামড়া খসে খসে পড়ছে। রাতভর খুব যন্ত্রণা হয়। দিনে অবশ্য টের পাওয়া যায় না। শোঁ শোঁ করে বাড়ছে বন্যার পানি। বৃষ্টিও। এই বর্ষায় ধান কাটা বড় বিপদের। শুকোবে কোথায়? আবার না কাটলেও বিপদ। জলের তলায় ডুবে যাচ্ছে সব। মাঠ-ঘাট, নদী-পুকুর। প্যাচপেচে কাদায় পা শিরশির করে মজনুর। দগদগে ঘাগুলো চিড়বিড়িয়ে ওঠে। স মিলের উঁচু শানবাঁধানো চাতালে ধানের আঁটিটা রেখে খানিক জিরিয়ে নেয় সে। করাতকলের ভেতর থেকে হাঁক দেয় জলিল মিয়া, ‘কী রে মজনু, কয় মণ হইল ধান?’মজনু জবাব দেয় না। নদীর গা ঘেঁষে করাতকল বসিয়েছে জলিল। বর্ষায় তাই কৃষকদের কাছে জলিলের এই শানবাঁধানো উঠানটা বড় লোভনীয়।জলিল এবার গলায় চড়ায়, ‘কী রে? কথা কস না ক্যান?’মজনু মিনমিনে স্বরে বলে, ‘না মাইপা কমু কেমনে?’‘তোর আন্দাজ নাই কট্টুক জমিতে ধান লাগাইছস?’জলিল সবই জানে। তার জমিতেই বর্গা চাষ করে মজনু। আধাআধি ভাগ। কিন্তু এবার বর্ষা বলে সুযোগটা নিচ্ছে সে। তার উঠান ছাড়া ধান মাড়াই করতে পারবে না কেউ। শুকাতেও পারবে না।জলিল বলে, ‘এইবারের ভাগের হিসাব ঠিক আছে তো? দুই ভাগ আমার আর একভাগ বর্গাচাষির।’‘বউডা পোয়াতি মেয়া ভাই, আমারে এইবার একটু ছাড় দেওন লাগব।’ মজনুর গলা নরম।‘বিয়া করলি কয় দিন, এর মধ্যেই পোয়াতি! এহন তো বছর বছর পোয়াতি হইব আর বছর বছরই আমি ছাড় দিমু?’‘না মেয়া ভাই, খালি এইবারই।’‘তাইলে খালি আমার ভাগের অর্ধেক ধানই নাও থেইকা নামাইস। তোর অর্ধেক নামাইস না। নিয়া যাইস। যেইখানে ইচ্ছা সেইখানে নিয়া রাখ। আমার হিসাবমতো ধান রাখনের লোকের অভাব নাই।’ জলিলের কণ্ঠ গম্ভীর।মজনু বলে, ‘এইবার ধানও কিন্তু আগেই কাইটা ফেলতে হইল। চিটা ধানও কম হইব না। বছরজুইড়া খামু কী?’জবাব না দিয়ে থক করে এক দলা থুতু ফেলে জলিল মিয়া। খানিক চুপচাপ বসে থেকে উঠে দাঁড়ায় মজনু। আকাশে মেঘ করেছে। এখনই আবার বৃষ্টি নামবে। দুদিন ধরেই থেকে থেকে ব্যথা উঠেছে মরিয়মের। যখন–তখন বাচ্চা প্রসব হবে। পাশের বাড়ির এছাহাকের বয়স্ক মা দাই। মরিয়মের সঙ্গেই আছে। ছনের ঘরের স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে ছাই ছিটিয়ে খানিক খটখটে করেছে সে। তার ওপর চটের বস্তা। বস্তার ওপর হোগলা পাতার মাদুর বিছানো। সেখানে মরিয়মের জন্য বানানো হয়েছে আঁতুড়ঘর।
মজনু যতক্ষণে জলিলের ভাগের ধান নামিয়ে নৌকা ছাড়ে, ততক্ষণে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তুমুল বৃষ্টি। বৃষ্টিতে নৌকায় ভিজতে থাকা ধানগুলোকে তার হঠাৎ নিজের সন্তানের মতো মনে হয়। তুমুল হাওয়ার প্রতিকূল স্রোতে পাগলের মতো নাও বাইতে থাকে মজনু, এই ধান তাকে বাঁচাতেই হবে।মজনুর বিশ্বাস, মরিয়মের ছেলে হবে। ছেলে হওয়ার সময়ে তার ঘরের চালের কলসি থাকবে ফাঁকা, এমন অলক্ষুণে ঘটনা সে কিছুতেই ঘটতে দেবে না।
মজনু উঠানে দাঁড়ানো। নাও থেকে ধান এখনো নামানো হয়নি। সে জানে না, প্রবল বৃষ্টিতে, জল-কাদায় প্যাচপেচে এই উঠানে ধানগুলো কোথায় রাখবে। বৃষ্টিতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে মজনুর। ঝাপসা চোখেই হঠাৎ এছাহাকের মাকে দেখে। ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে সে। কাঁদছে। আচ্ছা, এছাহাকের মা কাঁদছে কেন? মরিয়মের কি কিছু হয়েছে?মজনু জানে না। সে ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে, মরিয়ম শুয়ে আছে। তার চোখ বন্ধ। মরিয়মের শরীর কি নিঃসাড়? মজনু তা–ও জানে না। তবে অকস্মাৎ তার খেয়াল হয়, আঁতুড় ঘরের জায়গাটা ফাঁকা। শুকনো। খটখটে। মজনু হঠাৎ উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটতে থাকে।আরও বৃষ্টি আসার আগেই ধানগুলো এনে আঁতুড় ঘরে রাখতে হবে!